
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন, কিছু সংসদীয় কমিটির সভাপতি বিরোধী দল থেকে করা এবং প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিদ্যমান পদ্ধতি পরিবর্তনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় এই বিষয়গুলো নিয়ে ঐকমত্য হয়। তবে প্রধান বিচারপতির নিয়োগপ্রক্রিয়া কী হবে, তা নিয়ে আরও আলোচনা হবে।
দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের আলোচনার ভিত্তিতে যেসব সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেগুলো হলো অর্থবিল ও আস্থা ভোট ছাড়া অন্য যেকোনো বিষয়ে সংসদে নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যরা (এমপি) পূর্ণক্ষমতা পাবেন বা স্বাধীন থাকবেন। সরকারি হিসাব, অনুমিত হিসাব, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিশেষ অধিকার–সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি—এই চারটিসহ জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি পদ আসনের সংখ্যানুপাতে বিরোধী দলের মধ্য থেকে দেওয়া হবে। অর্থাৎ বিরোধী দলগুলো সংসদে যে কটি আসন পাবে, তার অনুপাতে সংসদীয় কমিটির সভাপতি পদ পাবে।
প্রথম পর্বে ঐকমত্যে হয়নি এমন প্রস্তাবগুলো নিয়ে দ্বিতীয় পর্বের মুলতবি আলোচনা শুরু। গতকাল অংশ নেয় ২৯ দল, জামায়াত যায়নি।
গতকাল দুপুর পৌনে ১২টার দিকে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমির দোয়েল হলে আলোচনা শুরু হয়। এক ঘণ্টার মতো মধ্যাহ্নবিরতি দিয়ে আলোচনা চলে বিকেল প্রায় সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত। আলোচনা শেষে এ দিনের সিদ্ধান্তগুলো সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। আজ বুধবার দলগুলোর সঙ্গে আবার আলোচনা হবে।
গতকালের আলোচনায় বিএনপি, জাতীয় নাগরিক পার্টি, ইসলামী আন্দোলন, নাগরিক ঐক্য, গণ অধিকার পরিষদ, গণসংহতি আন্দোলনসহ ২৯টি দল ও জোটের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। তবে গতকালের আলোচনায় জামায়াতে ইসলামী অংশ নেয়নি।
অন্যদিকে আলোচনায় অংশ নিয়ে যে প্রক্রিয়ায় জাতীয় ঐকমত্য তৈরির চেষ্টা হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। একটি দলের একজন ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে আলোচনা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব। কোন পদ্ধতিতে রাজনৈতিক দলগুলোকে কমিশনের আলোচনায় ডাকা হয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। এই প্রশ্ন গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হকও তুলেছেন। আলোচনাটি বিটিভি নিউজে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
প্রথম পর্বের আলোচনায় মৌলিক সংস্কারের যেসব প্রস্তাবে ঐকমত্যে হয়নি, সেগুলো নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে ২ জুন দ্বিতীয় পর্বের আলোচনার উদ্বোধন করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। পরের দিন ৩ জুন বিষয়ভিত্তিক আলোচনার মাধ্যমে দ্বিতীয় পর্বের আলোচনা শুরু হয়। সেদিন তিনটি বিষয়ে (সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ, স্থায়ী কমিটির সভাপতি মনোনয়ন ও সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন) আলোচনা হলেও সিদ্ধান্ত হয়নি। সেই মুলতবি আলোচনা গতকাল শুরু হয়। আলোচ্য সূচিতে ছিল ৩ জুনের তিনটি বিষয় এবং দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগপ্রক্রিয়া।
এর মধ্যে সংরক্ষিত নারী আসন বাড়িয়ে ১০০টি করে সরাসরি ভোটের বিধান করার প্রস্তাবে গতকালও ঐকমত্য হয়নি। এ নিয়ে দলগুলোর মতভিন্নতা থাকায় এ বিষয়ে আগামী সপ্তাহে আবার আলোচনা হবে। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনের বিষয়ে একধরনের ঐকমত্য হলেও কোনো কোনো দল দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ করার বিষয়ে নীতিগতভাবে দ্বিমত জানিয়েছে। উচ্চকক্ষের নির্বাচনপ্রক্রিয়া ও ক্ষমতা কী হবে, তা নিয়ে এখনো ঐকমত্য হয়নি।
আলোচনায় অগ্রগতি হচ্ছে। আশা করি, জুলাই মাসের মধ্যে জাতীয় সনদ প্রণয়ন করা সম্ভব হবে এবং সেখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা যাবে।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সহসভাপতি, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ
বিদ্যমান সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সংসদ সদস্যরা (এমপি) নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দিতে পারেন না। তাতে বলা আছে, কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থী হিসেবে কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি যদি ওই দল থেকে পদত্যাগ করেন বা সংসদে ওই দলের বিপক্ষে ভোট দেন, তাহলে সংসদে তাঁর আসন শূন্য হবে।
এই বিধানে পরিবর্তন আনার প্রস্তাব করেছিল সংবিধান সংস্কার কমিশন। তাদের প্রস্তাব ছিল, অর্থবিল ছাড়া অন্য যেকোনো বিষয়ে সংসদের নিম্নকক্ষের সদস্যদের নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার পূর্ণক্ষমতা থাকবে। দীর্ঘ আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হয়েছে, অর্থবিল ও আস্থা ভোট ছাড়া অন্য যেকোনো বিষয়ে সংসদ সদস্যরা নিজ দলের প্রস্তাবের বিরুদ্ধেও ভোট দেওয়ার স্বাধীনতা পাবেন।
গতকাল আলোচনায় অংশ নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ অর্থবিল ও আস্থা ভোটের সঙ্গে আরও দুটি বিষয় যুক্ত করার প্রস্তাব দেন। সেগুলো হলো সংবিধান সংশোধন বিল ও জাতীয় নিরাপত্তা জড়িত, এমন বিল ছাড়া সংসদ সদস্যরা দলের বিপক্ষে ভোট দিতে পারবেন। বিএনপির এই নেতা আরও বলেন, বিষয়টা এমন করা উচিত যে অর্থবিল ও আস্থা ভোটের বিষয়ে সবাই একমত। তবে এর বাইরে যদি কোনো দলের কোনো ‘কমিটমেন্ট’ থাকে, সে বিষয়ে তারা স্বাধীন থাকবে।
এনিসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেন, তাঁরা অর্থবিল ও আস্থা ভোটের বাইরে অন্য কিছু যুক্ত করার পক্ষে নন। কারণ, অতীতে জাতীয় নিরাপত্তার কথা বলে কালাকানুন করা হয়েছে। ব্যক্তি বা দলের ইচ্ছায় সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে।
আলোচনার একপর্যায়ে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, অর্থবিল ও আস্থা ভোট—এ দুটি বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। যখন জাতীয় সনদের খসড়া তৈরি করা হবে, তখন কারও ভিন্নমত থাকলে সেটা পরিশিষ্টে উল্লেখ করা যাবে।
পরে সংবাদ সম্মেলনে আলী রীয়াজ বলেন, ‘আমরা এ বিষয়ে একমত হতে পেরেছি যে ৭০ অনুচ্ছেদের বিদ্যমান বিধান পরিবর্তন করে অর্থবিল এবং আস্থা ভোটের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মনোনীত সংসদ সদস্যদের দলের পক্ষে ভোট দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকবে। এর বাইরে আর কোনো বিষয় থাকবে না। অর্থাৎ অর্থবিল এবং আস্থা ভোটের ক্ষেত্রে তাঁদের বাধ্যবাধকতা থাকবে যেন তাঁরা দলের পক্ষে ভোট দেন।’
সংরক্ষিত নারী আসন ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ
বিদ্যমান সংবিধানে নারীদের জন্য সংসদে সংরক্ষিত আসন আছে ৫০টি। কোনো দল বা জোট সরাসরি ভোটে ৩০০ আসনের মধ্যে যতটি আসন পায়, তার অনুপাতে ৫০টি নারী আসন বণ্টন করা হয়। এখানে পরিবর্তন এনে নারী আসন ১০০টি করা এবং এসব আসনে সরাসরি ভোট করার প্রস্তাব করা হয়েছে। দ্বিতীয় পর্বের আলোচনায় ৩ জুন এক দফা এবং গতকাল আরেক দফা আলোচনা হলেও এ নির্বাচনপদ্ধতি নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
আলী রীয়াজ এ বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেন, সংসদে নারী প্রতিনিধিত্বের বিষয়ে দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনা হয়েছে। জাতীয় সংসদের নারীদের জন্য ১০০টি আসন স্থায়ীভাবে করার ব্যাপারে সবাই একমত হয়েছে। পদ্ধতি এবং প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা অব্যাহত থাকবে। বিভিন্ন রকম প্রস্তাব আছে। আগামী সপ্তাহে এ বিষয়ে আলোচনা করে একমত হওয়া যাবে বলে আশা করছে ঐকমত্য কমিশন।
বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিয়ে থাকেন রাষ্ট্রপতি। এ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট করা নেই কাকে প্রধান বিচারপতি করা হবে। প্রধান বিচারপতি নিয়োগপ্রক্রিয়ায় কিছু পরিবর্তন আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করবেন রাষ্ট্রপতি।
এই প্রস্তাবের ক্ষেত্রে কোনো কোনো দল বিকল্প রাখার পক্ষে যুক্তি দিয়েছে। কেউ কেউ আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম তিনজন; কোনো কোনো দল দুজন বিচারপতির মধ্য থেকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়ার কথা বলেছেন।
এ প্রস্তাবের বিষয়ে আলী রীয়াজ বলেন, প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে সংবিধানের ৯৫ (১) ও ৪৮ (৩) অনুচ্ছেদ সংশোধনের বিষয়ে একধরনের ঐকমত্য হয়েছে। দুটি দল ছাড়া এ বিষয়ে অধিকাংশ দল এক জায়গায় এসেছে। এ বিষয়ে আগামী সপ্তাহে আরও আলোচনা হবে। কিন্তু প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ব্যবস্থা পরিবর্তনের ব্যাপারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ
বিদ্যমান ব্যবস্থায় জাতীয় সংসদ এক কক্ষের। সংবিধান ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন সংসদ বা আইনসভাকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করার প্রস্তাব করেছে। এ ক্ষেত্রে নিম্নকক্ষে ভোট হবে বিদ্যমান পদ্ধতিতে। আর উচ্চকক্ষ হবে ১০০ আসনের। নিম্নকক্ষে একটি দল সারা দেশে যত ভোট পাবে, তার অনুপাতে উচ্চকক্ষে আসন পাবে।
এনসিপি উচ্চকক্ষের প্রস্তাবিত নির্বাচনপদ্ধতির সঙ্গে একমত। তারা চায় উচ্চকক্ষের প্রার্থীতালিকা আগেই প্রকাশ করা হোক। অন্যদিকে বিএনপি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের প্রস্তাব সমর্থন করলেও নির্বাচনপদ্ধতি নিয়ে তাদের মত ভিন্ন। তারা চায় নিম্নকক্ষে একটি দল যতগুলো আসন পাবে, তার অনুপাতে উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন হবে।
অবশ্য কোনো কোনো দল দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ করার বিপক্ষে মত দেয়। তাদের যুক্তি হলো উচ্চকক্ষ করা হলে মাথা ভারী হবে। সংসদে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত নয় এমন প্রতিনিধি ২০০ (নারী আসনে ১০০ জনসহ) হয়ে যাবে। এটি সংবিধানের চেতনার সঙ্গে যায় না।
গতকালের আলোচনা শেষে সন্ধ্যায় আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ বা আইনসভার ব্যাপারে নীতিগতভাবে কিছু কিছু দল আপত্তি জানিয়েছে। অধিকাংশ দল ১০০ আসনের উচ্চকক্ষ গঠন করার বিষয়ে একমত হয়েছে। উচ্চকক্ষ তৈরির বিষয়ে আলোচনা শেষ হয়নি। বিশেষ করে নির্বাচনপ্রক্রিয়া ও দায়িত্ব কী হবে, তা নিয়ে আরও আলোচনা হবে বলে তিনি জানান।
আলী রীয়াজ বলেন, ‘আলোচনায় অগ্রগতি হচ্ছে। আশা করি, জুলাই মাসের মধ্যে জাতীয় সনদ প্রণয়ন করা সম্ভব হবে এবং সেখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা যাবে।’
আলোচনায় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, সফর রাজ হোসেন, ইফতেখারুজ্জামান ও মো. আইয়ুব মিয়া উপস্থিত ছিলেন। আলোচনা সঞ্চালনা করেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য) মনির হায়দার।